জমিয়ে আড্ডা ইন্টারনেট
 

মহাকাব্যে ঘৃণিতা নারী : মাতা কৈকেয়ী

সুচেতনা সরকার
বিষয় - প্রাচীন ভারত


কেকয় রাজকন্যা কৈকেয়ী ৷ গৌরাঙ্গী স্বর্ণবর্ণা ৷ দুর্গাপ্রতিমার মতো নিখুঁত মুখখানি ৷ ঘনপল্লবিত অরুণায়ত দুইটি কাজলকালো চোখে হরিণীর ব্যস্ততা তবু যেন অগাধ গভীর ৷ আজ কৈকেয়ী স্বয়ম্বরা হবেন ৷ সখীরা মিলে সাজাতে বসেছে তাঁকে ৷ শঙ্খশুভ্র দুইহাতে সযত্নে পরিয়ে দিয়েছে তারা শঙ্খবলয়,স্বর্ণকঙ্কণ, মরালগ্রীবায় নানাবিধ স্বর্ণলহরী হার, চন্দ্রশোভার মত ললাটে টায়রা, কোমরে চুনি পান্না পোখরাজ হীরকখন্ড মুক্তা জহরতের কাজ করা কোমরবন্ধনী, মণিমাণিক্য খচিত শতসহস্র রত্নালঙ্কারে সাজিয়ে দিয়েছেন সখীরা ৷ পরনে বহুমূল্য রত্নখচিত নীলাম্বরী ৷ ক্ষীণকটির উর্ধ্বভাগে রত্নখচিত স্বর্ণ কাঁচুলি -- উপজাতি সমাজের এই'ই অনুশাসন৷ ওদিকে রাজসভায় সহস্রাধিক রাজন্যবর্গ উপস্থিত ৷
প্রাচীন ভারত - মানচিত্র
প্রাচীন ভারতপ্রাচীন ভারতপ্রাচীন ভারত
প্রাচীন ভারত - মানচিত্র

কৈকেয়ী শুধু রূপশ্রেষ্ঠা'ই নন তিনি প্রখর বুদ্ধিমতী ৷ সখীদের হাস্যপরিহাসের অম্লমধুর কথোপকথনের মাঝে দৌড়ে আসেন কুব্জা মন্থরা, সুযোগ্যতম পাণিপ্রার্থীর সংবাদ নিয়ে -- তিনি আর কেউ নন, আর্য্যনৃপতি অযোধ্যারাজ দশরথ ৷ নক্ষত্রখচিত স্বয়ম্বরসভায় পুর্ণচন্দ্র একমাত্র রাজা দশরথ ৷ মণিবন্ধে জড়ানো মল্লীফুলের মালাটি সযত্নে পরিয়ে দেন দশরথের কণ্ঠে । তিনি দশরথের পুজারিণী নন মনমন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, দশরথের বিভ্রান্ত চাহনিতে কামনার আগুন নিভে গিয়ে ফুটে উঠলো অকপট বিস্ময় ৷ সদ্যপরিণীতার সঙ্গে হস্তবন্ধন হল রাজা দশরথের ৷

কুলদেবতার মন্দিরের গর্ভগৃহে হরপার্বতীর যুগল মূর্ত্তি প্রদক্ষিণ করতে করতে স্তিমিত আলোয় কৈকেয়ী দেখল অনিন্দ্যসুন্দর দশরথকে, প্রাণপ্রাচুর্য্যে ভরা সুন্দর সুঠাম তরুণ যুবক -- দুজনের শুভদৃষ্টি হল দেবতাকে সাক্ষী রেখে ৷ দুইটি হদৃয়ে যেন চঞ্চল বিদ্যুত্প্রবাহ ৷ দুই হদৃয়ের মিল ছাড়াও রাজনীতিজ্ঞ দশরথের কাছে কেকয়রাজের সঙ্গে আত্মীয়তা এক রাজনৈতিক জয় ৷ কিন্তু বিবাহের শেষপর্ব সিন্দুরদানের পূর্বে অনার্য্যরাজ অশ্বপতি দশরথকে কতোগুলি শর্ত্ত স্বীকার করতে বললেন ৷ প্রথমত কৈকেয়ী প্রধানা মহিষী হবেন, দ্বিতীয়ত কৈকেয়ীর পুত্রসন্তান অযোধ্যার রাজসিংহাসনের অধিকারী হবেন ৷ তৃতীয়ত প্রতিবাদী পুত্রদের নির্বাসন দিতে হবে ৷

বজ্রাহত দশরথ! বহুভাবনায় খুঁজে পেলেন আশার আলো ৷ ইতোমধ্যে দশরথের প্রজননশক্তির দৌর্বল্য প্রমাণিত হয়েছে ৷ তাই আর্য্যরাণী কৌশল্যা ও সুমিত্রার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আজ শীতলতর ৷ কৈকেয়ী যদি ইক্ষাকু বংশের বংশধর নিয়ে আসেন তবে সে হবে মহা সৌভাগ্য ৷ প্রখর বুদ্ধিমান রাজনীতিক দশরথ কেকয়নরেশকে বলেন আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য্য তবে আপনি আমার এই শর্ত্তের কথা চিরগোপন রাখবেন -- এটাই আমারও শর্ত্ত ৷

শর্ত্তের ওপরে শর্ত্তারোপ -- সিন্দুরদানে স্বস্তিবাচনে সাধ্বীসূত্র প্রদানে সম্পন্ন হলো শুভবিবাহ ৷ উপজাতি রাজকন্যা কৈকেয়ী পতিগৃহের পানে পা বাড়ালেন দশরথের হাত ধরে ৷ সঙ্গে এলেন অসামান্যা মেধাবী দাসী মন্থরা, সে বুদ্ধিমতী, বাকচতুরা, এবং সুন্দরী ৷ তার ঈষৎ বঙ্কিম গ্রীবা তাকে যেন আরো সুন্দরী করে তুলেছে ৷ তার মিষ্টি স্বভাব প্রখর বুদ্ধিমত্তা রানী কৈকেয়ীকে সদা রক্ষা করবে এ নি:সন্দেহ ৷ রাজপ্রাসাদে নতুন জীবন শুরু হল কেকয় রাজকন্যার , নব জনমে উত্তরিত হলেন রাজমহিষী হয়ে৷ দশরথের তিন রানীর মধ্যে কৈকেয়ী হলেন শ্রেষ্ঠা রূপে গুণে মর্য্যাদায় ৷

বর্ষা নামল ৷ নীল নবঘন আষাঢ় আকাশে শুধুই মেঘের ঘনঘটা ৷ নিথর কালো নিস্তব্ধ মেঘের আনাগোনা ৷ নীরব অধরা রূপসী বর্ষার মঙ্গল ঘট উপচে পড়েছে আজ দশরথের ঘরে, তিন রাণীই সন্তানসম্ভবা ৷ তাঁর ঔরসে গর্ভবতী ৷ মহা পুরুষ ঋষ্যশৃঙ্গ অসাধ্যসাধন করেছেন ৷ ভরা শ্রাবণের স্রোতস্বিনীর মতই আজ খুশীর জোয়ার এসেছে অযোধ্যার রাজপুরে ৷ চিন্তায় তলিয়ে গেলেন দশরথ -- মুহুর্মুহু শঙ্খধ্বনি আর উলুধ্বনিতে চমক ভাঙলো রাজার...


( চলবে )

২ এপ্রিল ২০০৮