জমিয়ে আড্ডা ইন্টারনেট
 

আউটসাইডার

কৃশানু বসু

প্রথম আলাপের জন্য কাঠখড় পোড়াতে হয় অনেকটাই ৷ তারপর আরো তিন ধাপ এগোনো হয়েছে ৷ অদৃশ্য শিরস্ত্রাণ খোলা না হলেও মুখোশের আড়াল সরিয়ে মুখই দৃশ্যমান তখন ৷ ভীষণই কনফিডেন্ট প্রদীপ্ত ৷ সে জানে তার চেহারায় জড়িয়ে আছে সেই ঝলক, যাকে 'হ্যান্ডসাম' এবং স্মার্ট' নামে অভিহিত করেন মফ:স্বলের তরুণ-তরুণীরাও ৷ এখন মুখোমুখী দোলা রায় ৷
"দোলা,আপনি বিপ্লববাদে বিশ্বাসী ৷ জানতে ইচ্ছে করে এই বিশ্বাসের ভূমিতে কখনো কি দোলা দেয় না ব্যক্তিগত কোনো অনুভূতি ?'
প্রদীপ্ত সেনগুপ্তের কথার মধ্যে জড়িয়ে থাকা রোমান্টিকতার নামে শ্লেষ বা ব্যঙ্গটুকু ধরতে পারে না দোলা, তেমন নয় ৷ তবু স্বভাববিরুদ্ধ ভঙ্গিমায় আক্রমণাত্মক না হয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, "এসব ছেঁদো প্রশ্নে জড়িয়ে থাকতে থাকতেও আপনি বেশ নামজাদা সাংবাদিক হয়ে গেলেন ৷ সিঙ্গুর কিন্তু আপনাকে প্রতিষ্ঠাও দিল ৷ সিঙ্গুর নিয়ে আপনার অতীব জোলো আবেগের প্রতিবেদনটি আমাদের কর্মীদেরও আপ্লুত করেছে ৷'
উত্সাহ বেড়ে যায় প্রদীপ্তের ৷ মনে মনে ভাবতে থাকে দোলা রায়কে অন্তত প্রাথমিক ভাবে গ্রিপ করা গেছে ৷ সিঙ্গুরের ভেতরের গল্প, ভেতরের আগুন নিয়ে আরো একটি বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছেন সম্পাদক ৷ দোলার সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রটিও খুঁজে দিয়েছেন তিনি ৷ ব্যাপারটিতে প্রদীপ্তের উপর অগাধ আস্থা তাঁর৷ দোলার সাক্ষাত্কার পাওয়া গেলে প্রতিবেদনটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় ভাবে দাঁড়িয়ে যাবে ৷
-- যতদূর জানি, আপনি সিঙ্গুরের মেয়ে নন ৷ সেক্ষেত্রে আপনাকে আউটসাইডার বলা কি খুব অসঙ্গত ?
-- আপনার প্রথম বাক্যটিতে কোনো প্রশ্ন নেই ৷ রয়েছে শস্তা একটি স্টেটমেন্ট ৷ এই শস্তা স্টেটমেন্টটি ঘিরেই সংক্ষেপে দু'একটা কথা আগে বলেনি ৷ মার্কসবাদ-মাওবাদ-অ্যান্টি মার্কসবাদ এসব অনেক ভারি ভারি বিষয় ৷ কিন্তু বাজারের ইতিহাস বইগুলো'ও উল্টেপাল্টে দেখেননি ৷ সাহিত্যের নামেও সম্ভবত পড়েছেন পপুলার কিছু কবিতা, গল্প, উপন্যাস৷ যেসবে ভাবালুতাই একমাত্র উপাদান৷ আর "আউটসাইডার' শব্দটির তাত্পর্য সত্যিই কি আপনার জানার কথা? তবু আপনার বোঝার মতো করেই বলি, হ্যাঁ, আমি একজন আউটসাইডারই ৷ অন্তত আপনাদের মতো উপরিতলের দক্ষ সাঁতারুদের কাছে আমি আউটসাইডার হয়েই থাকতে চাই ৷ আমার জন্ম কোথায়, কোথায় আমার বিচরণভূমি -- এসব আপনাকে বলা যাবে না ৷ কারণ, আপনি বুঝবেন না ৷
-- শুনেছি আপনি অর্থনীতির ছাত্রী, ভালো ছবিও আঁকেন --
-- তো ! আপনাকে সঙ্গে নিয়ে ক্যানভাসে এখন রং লাগাতে বসে যাই !
-- সিঙ্গুর নিয়ে আপনাদের এখন পরিকল্পনা কেমন ?
-- সেসব আপনাকে বলা যাবে না ৷
-- মিডিয়াকে ব্যবহার করে জনমত তৈরির সুযোগও তো একটা থাকে ৷
-- থাকে ৷ যখন থাকে, তখন থাকে ৷ এখন নেই ৷
-- টাটার কারখানা তো আপনারা আটকাতে পারলেন না ৷
-- আপনার সুবিধার্থে ধরে নিন আমরা ব্যর্থ হলাম ৷ কিন্তু এই ব্যর্থতা বা পরাজয়ের মধ্যে যে নিহিত শক্তি আর্জিত হয়, সে শক্তির তাত্পর্য বোঝার ক্ষেত্রে, একটি অর্থে সত্যিই আপনি আউটসাইডার ৷ আপনার সঙ্গে সে আলোচনা শেয়ার করা যায় না ৷ আপনি বরং আপনার বিশেষ প্রতিবেদনে নিজের খুশি মতো গল্প ঢুকিয়ে দিন ৷ আপনার কেরিয়ার আরো সমৃদ্ধ হবে ৷
উঠে যায় দোলা ৷ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ভঙ্গিমায় জড়িয়ে থাকে বিরক্তি ৷ আল পেরিয়ে ফিরে আসে ব্রাইট প্রদীপ্ত সেনও ৷ শেষ বিকেলের আলোয় তাকে আরো স্মার্ট দেখায় ৷


দু'সপ্তাহ পর খবরের কাগজ খুলতেই চমকে ওঠে দোলা রায় ৷ শিরদাঁড়া বেয়ে ক্রমশ উপরে উঠতে থাকে ক্রোধ ৷ সে-ক্রোধে একাকার হয়ে যায় ঘৃণা ৷ শরীর তোলপাড় করে উঠে আসতে চায় আবারো সেই দক্ষ সাপুড়ের সুর ৷ যে সুরের রেশ মুছে ফেলতে অনেকগুলো বছর খরচ হয়ে গেছে তার৷ ভুল স্বপ্ন, ভুল স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে অতল অন্ধকারের পথে যে মানুষটিকে সে পথিকৃৎ ভেবেছিল, অথচ যার সুরে অবিরত বয়ে যেত আলোর বন্দনা, সেই ভয়ংকর মানুষটি যেন হঠাৎ আবার'ও তার সামনে দাঁড়িয়ে যায় বিদ্রুপ-চাবুক হাতে ৷
"আলো আর অন্ধকার শব্দদুটি নিতান্তই আপেক্ষিক ! তুমি আসলে অবিরত একই বৃত্তে ঘুরে ঘুরে ধাক্কা খেয়ে যাবে' ৷
দোলা বুঝতে পারে আবার'ও সে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলছে প্রাথমিক আবেগের তরল উচ্ছ্বাসকে ৷ প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গানটির কথাগুলো মনে করতে পারে না কিছুতেই ৷ চেরাবান্ডা রাজুর কবিতা থেকে সুর দেওয়া গানটি কেন এখনো তাকে অনুপ্রাণিত করে, সে জানে না ৷ অথচ সে-সুরেও অতল বিষাদ ৷ ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে যায়, "যেতে হবে--যেতে হবে--দূরে--বহুদূরে---' ৷
প্রথম পৃষ্ঠার ডানদিকের তিন কলম জুড়ে হেডি :-- "সিঙ্গুরে রাইফেল হাতে নিমগ্ন বনলতা সেন ৷" টাটার কারখানা, উন্নয়ন-বিশ্বায়ন, কৃষকরমণীর বিদ্রোহ, ধর্ষণ, খুন, পুলিশী নির্যাতনের রঙিন বর্ণনার মধ্যে মিশে থাকে এক চূড়ান্ত বানানো গল্প ৷" একান্ত আলাপচারিতায় সে জানায়, হ্যামলেটদের সে ঘৃণা করে ৷ তবু ওফেলিয়ার আত্মহত্যাকে সমর্থন করে না ৷" উপসংহারে বিশেষ প্রতিবেদক আরো জানিয়েছেন, ''সিঙ্গুরেই খুঁজে পেয়েছেন দোলা তার প্রেমিকের সন্ধান৷ আপাতত প্রেমিকের পাশে রাইফেল হাতে প্রহরারত 'বনলতা সেন' ৷"

ক্যানভাস জুড়ে উপচে পড়ে লাল-নীল-কালো ৷ রঙের ধারা অবয়ব পায় মুখ ও মুখোশের৷ আক্রমণ-প্রতিরোধ-ব্যর্থতা-স্পর্ধা ৷ দোলা বুঝতে পারে না এ কোন ছবি ? ব্যর্থতা না সফলতার ?

বৃষ্টি হবে এখন৷ তবু ভিজতে ভিজতেই হাঁটতে হবে অনেকখানি পথ ৷



২৮ মে ২০০৮