জমিয়ে আড্ডা ইন্টারনেট
 

মহাকাব্যে ঘৃণিতা নারী : মাতা কৈকেয়ী

সুচেতনা সরকার

পর্ব : ১
পর্ব : ২

পর্ব : ৩


এমন সময়ে মন্থরা প্রবেশ করেছিলেন ধীরপদে ৷ কুব্জা মন্থরা কৈকেয়ীর মাতৃসমা ৷ কেকয়রাজ অশ্বপতির স্নেহভাজন গুপ্তচরী৷ মন্থরা প্রিয়ভাষিণী কৌতুকপ্রিয়া, এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ৷ রঙ্গকৌতুকে রাজপ্রাসাদের প্রতিটি মানুষকেই সহজেই আপন করে নিয়েছিলেন ৷ গোপন সংবাদ সংগ্রহের জন্যে যে সকলকেই প্রয়োজন! মন্থরা অতি সুচতুর রাজনীতিক ... ক্ষুরধার বুদ্ধিমতী ধৈর্য্যশীলা এবং চারুদর্শিনী ৷ শরীরে সামান্য বঙ্কিম ভাব যেন তার রূপের মর্য্যাদা বাড়িয়ে তুলেছে ৷
তিনি কৈকেয়ীর অভিভাবিকা ৷ ভরতের ধাত্রী মাতৃসমা এবং কল্যাণকামিনী ৷

সেই গভীর রাতে সদ্য বিপন্মুক্ত দশরথের কন্ঠলগ্না কৈকেয়ী যখন সোহাগে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছিলেন এমন সময়ে পায়ে পায়ে মন্থরা এসে বসেছিলেন দুয়ার প্রান্তে ৷ কুন্ঠাজড়িত স্বরে বলেছিলেন মহারাজ, মহারাণী কৈকেয়ী স্বভাবগোপনা , লজ্জাশীলা .. তাই ওঁর হয়ে আমি বর প্রার্থনা করছি ৷ বাধা দিয়েছিলেন রাজমহিষী ৷ আলুলায়িত মেঘঢাল কেশ ঢেকে দিয়েছিলো লাজুক সুদর্শনী মুখ ৷ বলেছিলেন মহারাজ বিপন্মুক্ত এই'ই আমার চরম সার্থকতা ! দুঃস্বপ্নের প্রহর অতিক্রান্ত হয়েছে...বর চাইনে মহারাজ ৷
দশরথ আর্য্যাবর্ত্তের প্রতাপশালী নৃপতি ৷ সামান্যা দাসীর নিবেদন রাখতে পারবেন না? অহংকারে আঘাত লাগে অযোধ্যাপতির ৷
রাজসুলভ গরিমায় দশরথ গর্বিত দৃষ্টিতে অনুরোধ করেন মন্থরাকে তাঁর নিবেদন জানাতে ৷

মন্থরা অতি বিনীত ভঙ্গিমায় মৃদুস্বরে বলেছিলেন সেদিন, মহারাজ যথা সময়ে কৈকেয়ী সেই দুইটি বর চেয়ে নেবে আপনার কাছ থেকে ৷

প্রাচীন ভারত

সেইদিন আজ উপস্থিত ৷ গবাক্ষে দাঁড়িয়ে রাজবধূ কৈকেয়ী ৷ সরযুর জলে অস্তগামী সুর্য্যের লাল রঙ গলে পড়ছে, কৈকেয়ীর দুই চোখ জ্বালা জ্বালা করছে... মন্থরা তাঁকে বুঝিয়েছে ভরতকে নিয়ে কতোবড়ো ষড়যন্ত্র রচনা হতে চলেছে এই রাজ পরিবারে ৷ আশ্চর্য্য!! পিতা কি করে তাঁর দুই সন্তান কে পৃথক দৃষ্টিতে দেখতে পারেন? কেমন করে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন? শুধু মাত্র আর্য্যত্বের দাবীতে এক সন্তান পিতার ভালোবাসার পূর্ণ ভাগীদার হতে পারে...আর আরেক সন্তানের ভাগ্যে শুধু অবিচার?
পিতা হয়ে পুত্রের সঙ্গে নির্লজ্জ মিথ্যাচার? দশরথের সঙ্গে মনে মনে কথা বলতে লাগলেন কৈকেয়ী... তুমি প্রতারক, প্রবঞ্চক, মিথ্যেবাদী ! নীচ, নিষ্ঠুর বিবেকহীন এক মানুষ ৷ কান্নায় ভেঙে পড়লেন রাণী কৈকেয়ী... এক অসহায় অনার্য্য মা ছাড়া এই মুহুর্ত্তে তাঁর যেন আর কোনো পরিচয়'ই নেই ৷ শুধু আজকের রাত... আগামীকাল রামের অভিষেক ৷ অজান্তে দেখলেন ভরতকে স্বপ্নে... অযোধ্যার রাজা হয়েছেন ভরত ৷ আর কৈকেয়ী রজমাতা ৷ তাঁর হাতে বরণডালা, মঙ্গলদীপ ৷ কপালে জয়টিকা লাগিয়ে দিচ্ছেন তিনি, আর সুবেশ সুসজ্জিত ভরত যেন মায়ের পা ছুঁতে যাবেন... ইনি আর্য্যাবর্ত্তে প্রথম অনার্য্য নরপতি!!

হঠাৎ ঘুম ভাঙলো মন্থরার হাতের শীতল স্পর্শে ৷ কখন মাথায় এসে হাত রেখেছেন , এই শত্রুপুরীতে একমাত্র স্নেহময়ী এই মন্থরা ৷ মন্থরার আলতো ছোঁয়ায় চোখ মেললেন কৈকেয়ী ৷ আবার যেন বাস্তব! ভরতের সাথে তঞ্চকতা, কেকয়রাজের সঙ্গে তঞ্চকতা করছেন দশরথ ৷
দশরথের কাছে এগিয়ে গেলেন রানী কৈকেয়ী ৷ অসহায় অপ্রকৃতিস্থ ভঙ্গিমা... একট সব হারানোর ছাপ ৷ রামকে তিনি ও যে কম ভালোবাসেন না! তবু রাম তো দোষী নয়! সব দোষ যে দশরথের!!
মহারাজ... আপনার কাছে বর প্রার্থনা করতে এসেছি ৷ প্রায়ান্ধ চোখে জ্বলে ওঠে বিদ্যুৎ শিখা! ভরত হবে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ৷ রামের অভিষেক না হয়ে হবে ভরতের অভিষেক ৷ কৈকেয়ী তনয় যুবরাজের মর্য্যাদা পাবে ৷ দশরথ হতবাক! এই কি সেই কৈকেয়ী? যে নিজের সন্তানকে তুচ্ছ করে রামকে ভালোবাসতেন?
আর দ্বিতীয় বর? দশরথ শুষ্ক কন্ঠে শুধান! এবারে এগিয়ে আসেন মন্থরা, কারন কৈকেয়ীর শেষ শক্তিটুকু নিঃশেষিত হয়েছিলো ৷ রাম প্রজা হয়েও অযোধ্যায় থাকতে পারবেন না ৷ তাঁকে চৌদ্দ বছরের জন্য বনবাস স্বীকার করতে হবে ৷ বাতায়নপথ প্রবল ঝঞ্ঝাবায়ু এসে শয্যাগৃহে আছড়ে পড়ে ৷ কৈকেয়ী বাকরুদ্ধ এবং দশরথ মূর্ছিত... প্রিয় পুত্র রাম!
আজ অভিষেকের দিনে এ কি দুর্দৈব?


শ্রীরাম... অপৌরুষেয় পুরুষোত্তম! সাহস দৃঢ়তা বিক্রম ও ব্যক্তিত্বের আশ্চর্য্য সমন্বয় ৷ রাম সম্যক ভাবে উপলব্ধি করতে পারলেন স্নেহস্নিগ্ধা মাতা আজ হঠাৎ এমন আচরণ করছেন কেন... রাজনীতির কদর্য্য রূপ যেন সরল স্বচ্ছ জলতলের মত স্পষ্ট হয়ে দেখা দিলো ৷ তিনি লোভী নন... অরণ্যের ডাক শুনতে পাচ্ছেন রাম ৷ অনার্য্যত্ব , উপজাতিত্বের মর্ম বুঝতে হলে প্রকৃত রাজার সম্যক অভিজ্ঞতা চাই ৷ তাই এই চতুর্দশ বত্সরের বনবাস রামের পক্ষে অতীব প্রয়োজন ৷ মাতা কৈকেয়ীর স্নেহে অবগাহন করেছেন রাম চিরকাল তাই আজও মাকে হাত জোড় করে বললেন -- মাতঃ তোমার মুখের একটি কথায় আমি সব ভরতকে দিয়ে দিতাম... মাগো ৷ তুমি বললেনা সেকথা মুখ ফুটে?
বিরাট অরণ্যভূমিতে আমি স্থান করে নেব মা ৷ বিদায় দাও ৷

বিষাদিত মাতা কৈকেয়ী... পিতা দশরথ... চতুরঙ্গ বাহিনী আয়ুধ শকট অশ্ব ধন রত্ন সব সাজলো... সুমন্ত্রের রথে করে রাম নগর সীমার বাইরে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলেন ৷

মাতা কৈকেয়ী ইতিহাসের পাতায় বয়ে চলেছেন ঘৃণার স্বাক্ষর আজও ৷ ভরত ফিরে এসেছিলেন পিতার আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ৷ ভরতজননী কি নিজের সন্তানের সঙ্গেও দৃষ্টি মেলাতে পেরেছিলেন?
আজও যেন জননী কৈকেয়ী ক্ষমা ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন অযোধ্যার সিংহদুয়ারে, পথ চলতি পাঠক পাঠিকা করুণার দৃষ্টিক্ষেপ করে চলে যান ৷ দাঁড়িয়ে থেকে দুদন্ড কথা বলার সময় যে নেই কারোর ৷
মাতা কৈকেয়ীর একটি অশ্রুবিন্দু যেন হীরক খন্ড হয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দেয় ...মায়ের করুণ আকুতি দুই চোখে ৷
কুপুত্র যদিবা হয় কুমাতা কখনো নয়! কুমাতা কি কেউ কখনও হয়?
যদি কোনো দিন পথ ভুলে কোনো সুচেতনা এসে পড়ে... মনের কথা হয়... গভীর ভালোবাসায় আলতো করে হাত ছোঁয়ান জননী কৈকেয়ী... ফিসফিস করে বলেন... এ জীবন পুণ্য করো দহন দানে !!


(শেষ)

১৬ এপ্রিল ২০০৮